পৃথিবী, আমাদের সৌরজগৎ তথা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তার উপর সর্বাধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত এবং সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ হল বিগ ব্যাং তত্ত্ব (Big Bang Theory)। বেলজিয়ামের মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ (Cosmologist) ও ধর্মযাজক জর্জেস লেমাইত্রে (Georges Lemaître, 1894-1966) ১৯২৯ সালে বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। তাই তাকে বিগ ব্যাং তত্ত্বের জনক বলা হয়। ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল (Fred Hoyle) ১৯৪৯ সালের মার্চে বিবিসি রেডিও সম্প্রচারের জন্য একটি বক্তৃতার সময় “বিগ ব্যাং” শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।
অনেকের ধারণা ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বিগ ব্যাং তত্ত্বের জনক, কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। তিনি ‘A Brief History of Time’ নামে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে বিগ ব্যাং তত্ত্বের সর্বাধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র।
বিগ ব্যাং তত্ত্বের মূল বক্তব্য
মহাজাগতিক বীজঃ প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে বর্তমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সেই সময় মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ ও শক্তি একটি স্থানে অতি ক্ষুদ্র বলের আকারে পুঞ্জীভূত ছিল। এই ক্ষুদ্র পুঞ্জীভূত বলটিকে ‘সিঙ্গুলারিটি’ (Singularity) নাম দেওয়া হয়েছে এবং এটির মধ্যে ছিল প্রচন্ড তাপ, চাপ, অতি উচ্চ ঘনত্ব এবং অসীম ভর। এই সিঙ্গুলারিটির মধ্যেই সুপ্ত ছিল বর্তমান বিশাল, অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। পুঞ্জীভূত বলটি থেকেই পরবর্তীতে গোটা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। তাই একে মহাজাগতিক বীজ (Cosmic Egg) বলা হয়।
মহাবিস্ফোরণঃ আদিম পুঞ্জীভূত ক্ষুদ্র বল (অতি ক্ষুদ্র বিন্দু বলে মনে করেন অনেক বিজ্ঞানী), যাকে বিজ্ঞানীরা সিঙ্গুলারিটি নাম দিয়েছেন, তার মধ্যে মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ, শক্তি প্রচন্ড চাপ, তাপে অসীম ঘনত্ব ও ভর নিয়ে অবস্থান করত। হঠাৎ ওই পুঞ্জীভূত বলটির মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে এবং সেখান থেকে সমস্ত পদার্থ, শক্তি বিস্তারিত হতে থাকে। আকস্মিকভাবে এক মুহূর্তের বিস্ফোরণেই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। সিঙ্গুলারিটির মধ্যে অসীম ঘনত্বে যে পদার্থ সংকুচিত অবস্থায় জমা ছিল তাই প্রসারিত হয়ে হাজার হাজার কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র তথা গ্যালাক্সির নির্মাণ হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। স্থান, সময় ও শক্তি এই তিনটি প্রধান ধারণাও বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের পরে মহাবিশ্বে এসেছে। তবে বাস্তবে কোন বিস্ফোরণ ঘটেছিল কিনা সে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন বিগ ব্যাং আসলে কোন বিস্ফোরণ নয় বরং সিঙ্গুলারিটি থেকে পদার্থের ক্রমাগত প্রসারণকে (Expand) বোঝায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এখনও প্রতিমুহূর্তে প্রসারিত হয়ে চলেছে। ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী Edwin Hubble মহাবিশ্ব যে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে এই ধারণা বিশ্বের কাছে পেশ করেন।
নক্ষত্রের জন্মঃ জর্জেস লেমাইত্রে আদিম পুঞ্জীভূত বলের পদার্থগুলির ক্ষুদ্র কণাগুলিকে প্রাইমিভাল এটম (Primeval Atom) নাম দেন। এই এটমগুলি একত্রিত হয়ে পরবর্তীতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের সমন্বয়ে সুবিশাল মেঘ তৈরি করে যাকে আমরা নীহারিকা বলি। নীহারিকা আরও ঘনীভূত হয়ে গ্যাসীয় পিণ্ডে পরিণত হয় এবং নক্ষত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। আবার বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র মিলে তৈরি হয় এক একটি গ্যালাক্সি।
গ্রহাণু ও গ্রহের সৃষ্টিঃ প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে গ্যাসীয় পিণ্ড এবং ধূলিকণার মেঘপুঞ্জ শীতল ও ঘনীভূত হয়ে গ্রহগুলির সৃষ্টি হয়েছে। আর যে সমস্ত বস্তুকণা মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের গ্রহাণু বলা হয়। মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে অনেক সংখ্যক গ্রহাণু অবস্থান করছে। এই গ্রহাণুগুলি অন্যান্য গ্রহের মতো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে সেই বিষয় ব্যাখ্যা করে। আমাদের সৌরজগতের আটটি গ্রহ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা ল্যাপলাসের নীরীহারিকা মতবাদে (Nebula Hypothesis) বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে।
আরও পড়- শাস্ত্র হিসেবে ভূগোল MCQ, একাদশ শ্রেণীর ভূগোল প্রথম অধ্যায়
বিগ ব্যাং তত্ত্বের গুরুত্ব
বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্বঃ পৃথিবী সহ সম্পূর্ণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ কীভাবে হয়েছে সেই সম্পর্কে সবচেয়ে প্রমাণিক, নির্ভরযোগ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করে বিগ ব্যাং তত্ত্ব। ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টিরহস্য ভেদে যে সমস্ত বিজ্ঞানী কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই এই তত্ত্বকে মেনে নিয়েছেন।
আইনস্টাইন তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিতঃ পদার্থবিজ্ঞানের বহু গবেষণা এবং আবিষ্কার মহান পদার্থবিদ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং মহাকর্ষীয় সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। আইনস্টাইনের দেওয়া তত্ব ও সূত্রগুলি পদার্থবিজ্ঞানের জগতে মূল ভিত্তি স্বরূপ, আর সেই তত্ত্ব ও সূত্রগুলি অবলম্বন করেই বিগ ব্যাং থিওরি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
বিগ ব্যাং তত্ত্বের সমালোচনা
- বিগ ব্যাং তত্ত্বে বলা হয়েছে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পূর্বে একটি ক্ষুদ্র বল বা বিন্দুর মধ্যে সমস্ত পদার্থ এবং শক্তি কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু তার আগে সমস্ত বস্তুকণার উৎস কী ছিল ? কোথা থেকে সেগুলি এলো ? ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির উপর অন্যান্য তত্ত্বের মতো এই তত্ত্বেও তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
- মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে কিন্তু এই প্রসারণ কতদিন পর্যন্ত চলবে ? মহাবিশ্বের পরিধি কী সীমাহীন ভাবে বাড়তেই থাকবে ? নাকি কোন এক সময়ে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হবে। এইসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর বিগ ব্যাং থিওরিতে নেই।
আরও পড়- পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত জোয়ার মতবাদ, জিনস এবং জেফ্রি
আরও পড়- WBCS পরীক্ষা সম্পর্কে A-Z খাঁটি তথ্য, সমস্ত তথ্য এক ক্লিকেই