করোনার ক্ষত এখনও শুকায়নি মানুষের মন থেকে তারমধ্যে আবার নতুন এক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অশনিসংকত দিতে শুরু করেছে। Mpox নামে এই নতুন ভাইরাস ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে দাপট দেখাতে শুরু করেছে। অনেক দেশে প্রাণ হানির খবরও প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি ভারতেও Mpox আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান মিলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তরফে এই ভাইরাস সম্পর্কে ইতিমধ্যে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। এই ভাইরাসের ইতিহাস ও এটি মানব সভ্যতার জন্য কতটা বিপজ্জনক তাই নিয়েই আজকেই পর্যালোচনা।
Mpox ভাইরাসের ইতিহাস: Mpox virus history
Mpox পূর্বে “Monkeypox” নামে পরিচিত ছিল। এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। রোগটি প্রথমবার শনাক্ত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কে গবেষণারত বানরের মধ্যে। এই রোগটি মূলত ইঁদুর এবং অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ছড়ায়। ১৯৭০ সালে, কঙ্গোতে প্রথম মানবদেহে এই রোগের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। একটি ৯ মাসের ছেলের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ২০২২ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই ভাইরাসের নতুন নাম “Mpox” ঘোষণা করে। এই ভাইরাস শুধুমাত্র বানর প্রজাতির মধ্যেই সংক্রমণ ঘটায় না, মানুষকেও আক্রান্ত করে, অপরদিকে ‘Monkeypox’ নামের মধ্যে বানর প্রজাতিকে হেয় করার ইঙ্গিত রয়েছে, তাই পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করা হয়।
এমপক্স এর লক্ষণ ও সংক্রমণ: Mpox symptoms
Mpox আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে সাধারণত জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীতে ব্যথা, এবং মুখমণ্ডল থেকে শুরু হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া র্যাশ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। পরে ওই র্যাশ লাল ফোঁড়ার মতো আকৃতি নেয়।
প্রধানত আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কেউ এলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের ফ্লুইড বা সংক্রমিত বস্তুর মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এমনকি বিজ্ঞানীদের দাবি, কোনো জড়বস্তুর মধ্যেও Mpox ভাইরাস দীর্ঘদিন জীবিত থাকতে পারে। মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসযন্ত্রের ড্রপলেট এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, এবং অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। প্রাণীদের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে Mpox ভাইরাস ছড়াতে পারে। বিজ্ঞানীদের অনুমান প্রথম মানব সংক্রমণটি সম্ভবত সংক্রামিত ইঁদুর বা অন্যান্য প্রাণীর সংস্পর্শে এসে ঘটেছিল। যদিও বানরদের মধ্যে প্রথম এই ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছিল। তবে ইঁদুরজাতীয় প্রাণীগুলি ভাইরাসটির প্রকৃত বাহক বলে মনে করা হয়।
বিশ্বজুড়ে প্রভাব
২০২২ সালে Mpox ভাইরাসের প্রকোপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ১১৬টিরও বেশি দেশে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার খবর সামনে এসেছে এবং প্রায় ১৮,০০০ এর বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আফ্রিকাতে সবচেয়ে বেশি Mpox এর প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। আফ্রিকার মোট আক্রান্তর ৯৬% শুধুমাত্র কঙ্গোতেই পাওয়া গেছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬০% শতাংশ ১৫ বছর বয়সী শিশুরা। কঙ্গো এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে এই রোগের ফলে মৃত্যুর হার ৩-৪% পর্যন্ত পৌঁছেছে। অন্যান্য দেশে মৃত্যুর হার কম থাকলেও (প্রায় ১%) বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে দঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন- কৃষক বন্ধু প্রকল্প কি ? এর আওতায় মিলবে ১০০০ টাকা !
ভারতে বর্তমান অবস্থা
ভারতে প্রথম Mpox আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায় ২০২২ সালে কেরালায়। বর্তমানে ভারতে ৩০ জনের মধ্যে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। ভারতে সংক্রমণ এখনও আয়ত্তের বাইরে না গেলেও আশঙ্কা থেকেই যায়। বিশেষত পাকিস্তানে মারণ ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ভারতেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার, দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা, এবং প্রয়োজনে টিকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Mpox ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট
Mpox ভাইরাসের দুটি প্রধান ভ্যারিয়েন্ট বা ক্লেড রয়েছে, যথা-
- Clade I (Congo Basin clade):
- অঞ্চল: মূলত কঙ্গো বেসিন ও মধ্য আফ্রিকাতে পাওয়া যায়।
- ভয়ঙ্করতা: এই ভ্যারিয়েন্টটি বেশি প্রাণনাশী এবং মারাত্মক। এর মৃত্যুহার প্রায় ১০%, অন্য ভ্যারিয়েন্ট Clade II এর তুলনায় এটি অনেক বেশি প্রাণঘাতি।
- সংক্রমণ: এটি দ্রুত হারে একজনের শরীর থেকে অপর ব্যক্তি মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
- Clade II (West African clade):
- অঞ্চল: পশ্চিম আফ্রিকায় প্রধানত পাওয়া যায়।
- ভয়ঙ্করতা: এই ভ্যারিয়েন্টটি তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক। এর মৃত্যুহার ১% এর কম।
- সংক্রমণ: এই ভ্যারিয়েন্ট কিছুটা কম সংক্রামক, তবে জনস্বাস্থ্যের জন্য চিন্তার বিষয়।
সংক্রমণ অনুযায়ী বিশ্বের অবস্থা
- Clade II মূলত পশ্চিম আফ্রিকাতে পাওয়া যায়। বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন ইউরোপ ও আমেরিকা। এটি তুলনামূলকভাবে কম প্রাণনাশী হলেও এর সংক্রমণের হার বেশি।
- ভারত, পাকিস্তান, এবং অন্যান্য দেশগুলোতে Clade II সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে এবং এই ভ্যারিয়েন্টটি ভারতেও ছড়াতে শুরু করেছে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
বর্তমানে Mpox ভাইরাসের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। উপসর্গ দেখে বর্তমানে ডাক্টাররা চিকিৎসা করছেন। Smallpox-এর জন্য তৈরি কিছু টিকা যেমন MVA-BN, LC16 ইত্যাদি, Mpox প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, এই টিকা শুধুমাত্র সংকটজনক রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এই অবস্থায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
শেষকথা
Mpox ভাইরাস একটি গুরুতর স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। তাই করোনার সময় আমরা যে ভুল করেছিলাম তা আবার করাটা মারাত্মক বোকামি হবে। তাই আবার কোনো প্যানডেমিক যাতে না আসে সেজন্য সরকার ও জনগণকে আগাম সতর্ক হতে হবে। সঠিক পদক্ষেপ এবং সতর্কতা গ্রহণ করলে Mpox নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সহযোগিতায় ও সদর্থক ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন- পলিগ্রাফ টেস্ট কি ? মিথ্যা কথা বললেই ধরা পড়ে যাবেন ! মারাত্মক এই পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে নিন ঝটপট
আরও পড়ুন- মিশরের পিরামিড রহস্য ফাঁস ! পিরামিড সম্পর্কে অজানা তথ্য ভাণ্ডার
আরও পড়ুন- অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস ও তার ৩ হাজার বছরের জীবনচক্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয়