রূপনারানের কূলে কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর: Rupnaraner Kule kobita question answer

রূপনারানের কূলে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (৭ মে ১৮৬১ – ৭ আগস্ট ১৯৪০) বাংলা সাহিত্যের সর্ব শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ভাবা হয়। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই আসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাই তঁকে ‘কবিগুরু’ বলা হয়। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘Song Offerings’ এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল, সোনারতরী, খেয়া,মানসী, ভারতবর্ষ, পঞ্চভূত প্রভৃতি। ‘শেষলেখা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে পাঠ্য কবিতাটি নেওয়া হয়েছে।

১ প্রশ্নঃ  “রূপ-নারানের কূলে জেগে উঠিলাম”  – তাৎপর্য। 

উত্তরঃ   কবিগুরুর সারাজীবনের আত্মোপলব্ধি উক্ত পঙ্‌ক্তিটির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।‘রূপনারান’ এখানে কোনও নদীর নাম নয়; এই বাস্তব পার্থিব জগৎ সংসারকেই কবি ‘রূপনারানের কূলে’ বলে অভিহিত করেছেন।  

আমরা সারাজীবন ব্যাপী নানা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হই। এটাই জীবনের ধর্ম।রবীন্দ্রনাথও আপন মহিমায় শ্রেষ্ঠ হলেও তিনিও ব্যতিক্রমী নন, বরং তিনিও জীবন জুড়ে নানান ভ্রান্ত ধারণার শিকার হন। ‘জীবন’কে তিনি এক স্বপ্নময় তরী রূপে ভেবেছিলেন।আনন্দ-উল্লাসের রস আস্বাদনের মধ্যেই বেঁচে থাকার সার্থকতা এমন ভাবনা ছিল কবির মনে।কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে কবির যেন ‘জ্ঞানচক্ষু’ খুলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন এই জীবন, বাস্তব জগৎ মোটেও ‘পুষ্পশয্যা’ নয়। ‘সত্য যে কঠিন’ এই উপলব্ধি হল তাঁর। বাস্তবের রুক্ষ জমিতে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারলেন অনন্ত দুঃখ – কষ্টে ভরা এই জীবন আমৃত্যু ‘দুঃখের তপস্যা’। তাঁর এই চেতনার উদয়কেই কবি ‘জেগে উঠিলাম’ বলে উল্লেখ করেছেন।

  • আত্মোপলব্ধি – নিজে বুঝে কোনও জ্ঞানলাভ করা।
  • পার্থিব জগৎ- এই পৃথিবীর জগৎ, যা দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়।
  • ‘জ্ঞানচক্ষু’ খুলে গেল- কোনও কিছু বুঝতে পারলেন।
  • জীবন সায়াহ্নে- জীবনের শেষকালে।
  • ‘পুষ্পশয্যা’ নয়- জীবনটা সুখের নয় বা আরামের নয়।

প্রশ্নঃ রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ

                চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়”   তাৎপর্য

উত্তরঃ   কবিগুরু রবিন্দ্রানাথের জীবন উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করে উক্ত পঙ্‌ক্তিটি। তিনি সারাজীবন একটি ভ্রমের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। তিনি মনে করতেন বেঁচে থাকাটা আসলে আনন্দ- উচ্ছ্বাসে গা ভাসিয়ে নিশ্চিন্তে চলা। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁর বদ্ধমূল ধারণার গোড়ায় কঠিন কুঠারাঘাত পড়ল। ভুল ভাঙল তাঁর।

জীবনে চলার পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কবি বুঝতে পারলেন জীবন বড়ো কঠিন। ‘স্বপ্ন’ বলে মনে করা জীবনকে তিনি নতুন করে দর্শন করলেন। নিজ জীবন স্রোতের নানা বাকে বাকে নানান দুঃখ-যন্ত্রণার সিক্ত হয়ে; বহু ‘আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়’ দগ্ধ হয়ে  তিনি আত্মোপলব্ধি করলেন জীবন বড়োই কষ্টের- কঠিন- কর্কশ। এই উপলব্ধিকেই তিনি কবিতায় ‘রূপ-নারানের কূলে জেগে উঠিলাম’ বলে ব্যক্ত করেছেন। তিনি নিজের জীবন যাত্রায় বিভিন্ন দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হয়েছেন। সেই আঘাত-যন্ত্রণায় কাতর হয়েই জীবনের বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। সেটাকেই  তিনি আপন কবিত্ব প্রতিভায় ‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

  • বদ্ধমূল ধারণার গোড়ায় কঠিন কুঠারাঘাত পড়ল- তিনি যা এতদিন ভেবেছিলেন সেই ভাবনা ভুল বলে বুঝতে পারলেন।
  • ঘাত-প্রতিঘাতের- বাধা-বিপত্তি।
  • নতুন করে দর্শন করলেন- নতুন করে চিনলেন।
  • ব্যক্ত করেছেন- বলেছেন।

প্রশ্নঃ  “সত্য যে কঠিন

                 কঠিনেরে ভালোবাসিলাম” 

সে কখনো করেনা বঞ্চনা”    তাৎপর্য

উত্তরঃ  জীবনের কঠোর এক বাস্তবকে কবি উক্ত পঙ্‌ক্তির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। আমাদের সংস্কৃতির বুনিয়াদ ‘সত্যম সুন্দরম’ এই মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবের রুক্ষ ভূমিতে দাঁড়িয়ে  কবি উপলব্ধি করলেন জীবনে চলার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হয়। জীবনটা শুধু কল্পনার বিলাসে বিভর হয়ে এক সুখের স্বপ্নে মত্ত হয়ে কাটিয়ে দেওয়া নয়। বরং জীবনের স্তরে স্তরে দুঃখ-কষ্টের কাঁটা বিছান।

জীবনের এই অনন্ত দুঃখের যন্ত্রণার হাত  থেকে মুক্তির উপায় নেই। বেঁচে থাকতে গেলে সুখ-দুঃখের চক্রের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে। কবি এই কঠোর বাস্তব সত্যটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ বলেছেন। কবি আসলে জীবনের আঘাত থেকে পরিত্রাণের কোনও পথ নেই বলেই সেই কঠোর ‘সত্য’টাকে মেনে নিয়েছেন। সুখ-দুঃখকে নিত্য সঙ্গী করে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে জীবন যাত্রায়। জীবনে যাই ঘটুক না কেন সব কিছুকেই হাসি মনে গ্রহণ করে নিতে হবে। আর যা সত্য-বাস্তব তা কঠিন ও পীড়াদায়ক; সেটা কখনই মনকে প্রলুব্ধ করে না। মনকে মিথ্যা প্রবঞ্চনা করা তো আশার কুহকিনীর কাজ। কবির এই জীবন বোধ আমাদের বেঁচে থাকার পাঠ শেখায়। কবি মননের গভীর চেতনা উক্ত পঙ্‌ক্তিটির মধ্যে প্রকাশিত।

  • সংস্কৃতির বুনিয়াদ- আমাদের দেশের সংস্কৃতির ভিত্তি হল ‘সত্যম সুন্দরম’ মন্ত্র। ( ভিত্তি- পাকা ঘর বানাতে যে ভিটি থাকে তাকেই ভিত্তি বলে )
  • প্রতিবন্ধকতা- বাধা – বিঘ্ন।
  • পরিত্রাণ- পালানোর বা বাঁচার কোন পথ নেই।
  • আশার কুহকিনী- যা মিথ্যা ছলনা দেখায়। মিথ্যা আশা জাগায়।
  • বেঁচে থাকার পাঠ শেখায়- কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় সেটা শেখায়।
  • কবি মননের গভীর চেতনা উক্ত পঙ্‌ক্তিটির মধ্যে প্রকাশিত- কবির মনের গভীর ভাবনা উক্ত কবিতার লাইটির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। (কবিতার একটি লাইনকে পঙ্‌ক্তি বলা হয়)

প্রশ্নঃ  “আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এই জীবন”    তাৎপর্য

উত্তরঃ   কবিগুরু রবীন্দ্রানাথের সারাজীবনের আত্মোপলব্ধি উক্ত পঙ্‌ক্তিটির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। জীবন যে শুধুমাত্র সুখ-সমৃদ্ধে পুষ্ট নয়, এতে দুঃখ-যন্ত্রণার অসহ্য গরলও পদে পদে আমাদের পান করতে হয়, এই সত্যকে কবি বুঝতে পারলেন।

আমরা সারাজীবন ব্যাপী নানা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হই। এটাই জীবনের ধর্ম।রবীন্দ্রনাথও আপন মহিমায় শ্রেষ্ঠ হলেও তিনিও ব্যতিক্রমী নন, বরং তিনিও জীবন জুড়ে  নানান ভ্রান্ত ধারণার শিকার হন। ‘জীবন’কে তিনি এক স্বপ্নময় তরী রূপে ভেবেছিলেন।আনন্দ-উল্লাসের রস আস্বাদনের মধ্যেই বেঁচে থাকার সার্থকতা এমন ভাবনা ছিল কবির মনে।কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে কবির যেন ‘জ্ঞানচক্ষু’ খুলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন এই জীবন, বাস্তব জগৎ মোটেও ‘পুষ্পশয্যা’ নয়। ‘সত্য যে কঠিন’ এই উপলব্ধি হল তাঁর। বাস্তবের রুক্ষ জমিতে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারলেন অনন্ত দুঃখ – কষ্টে ভরা এই জীবন। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকি প্রতিনিয়তই নানান ঘাত-প্রতিঘাত, আঘাত-পীড়া সহ্য করে জীবন পথে এগিয়ে যেতে হয়। কখনও শেষ না হওয়া এই যাতনার অবসান মৃত্যুর মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি  ঘটে। বেঁচে থাকতে এর থেকে মুক্তি নেই।  কবির এই চিরন্তন সত্য উপলব্ধিই পঙ্‌ক্তিটিতে ধরা দিয়েছে।

  • এতে দুঃখ-যন্ত্রণার অসহ্য গরলও পদে পদে আমাদের পান করতে হয়- দুঃখ-যন্ত্রণাকে গরল মানে বিষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই দুঃখ-যন্ত্রণা বিষের মতোই আমাদের ব্যথা দেয়। আর সেই বিষকে মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে পান করতে হয়। 
  • স্বপ্নময় তরী- স্বপ্নের নৌকা, যে নৌকায় চেপে আমরা সুখের স্বপ্ন দেখতে দেখতে পাগলের মতো এগিয়ে যাই। এখানে কল্পনার জগতে বাস করাকে বোঝান হয়েছে।
  • আনন্দ-উল্লাসের রস আস্বাদনের মধ্যেই বেঁচে থাকার সার্থকতা- আনন্দ- উল্লাসে পুরো জীবন enjoy করছি। খালি স্বপ্ন দেখে দেখে বিছানায় গোড়াগোড়ি খাচ্ছি ! এমন জীবনকেই কবি সার্থক বা ঠিক বলে এতদিন ভেবেছিলেন।
  • বাস্তবের রুক্ষ জমি- বাস্তব খুব কঠিন তাই বাস্তব জগতকে রুক্ষ জমি, মানে শুকনো-খটখটা বিশ্রী জমি বলা হয়েছে। যার কোনও রস-কস নেই।
  • চিরন্তন সত্য- যা সবসময় সত্যি। যেমন- পরিশ্রম না করলে জীবনে উন্নতি করা যায় না, এটা বাস্তব সত্য।
  • যাতনা-বেদনা , ব্যথা।

প্রশ্নঃ   “মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে”     তাৎপর্য

উত্তরঃ   কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতা থেকে পঙ্‌ক্তিটি নেওয়া। পঙ্‌ক্তিটির মধ্য দিয়ে কবি জীবনের এক চরম বাস্তবতা তথা ধ্রুব সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

আমরা একদম খালি হাতে জন্ম গ্রহণ করি। কিন্তু জীবন ব্যাপী বিভিন্ন মূর্ত এবং বিমূর্ত বিষয় অর্জন করে থাকি। জীবদ্দশায় এই পার্থিব জগৎ থেকেই বাড়ি-ঘর, জমি-জমা থেকে শুরু করে অন্যান্য সম্পদ এবং যশ-খ্যাতি-সুনাম ছাড়াও বহু মানুষের মায়া-মমতা-ভালোবাসা-স্নেহ লাভ করি। জন্মের পর থেকেই জগৎ-সংসারের সঙ্গে আমাদের যেন দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক। বেঁচে থাকতে আমরা শুধু জগৎ থেকে ঋণ নিয়েই গেলাম, পরিশোধ আর করলাম না। কিন্তু দৈব নিয়মেই সেই ঋণ মুকুবের দিন যেন আমাদের সবার জীবনে নির্দিষ্ট হয়ে আছে। কালবেলায় মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আবার আমরা নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত হই। জগৎ-সংসার থেকে যা কিছু নিয়েছি সমস্ত কিছুর উপর আমাদের অধিকার ছেড়ে দেই। আমাদের যা কিছু ছিল সব কিছুই এই জগতেই ফিরিয়ে দেই। যেমন ভাবে এসেছিলাম ঠিক তেমনি ভাবেই খালি হাতে ফিরে যাই। কবি একেই ‘সকল দেনা শোধ’ করা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কবিত্ব প্রতিভা এবং জীবন বোধের পরিচয় উক্ত পঙ্‌ক্তিতে পাওয়া যায়।

  • ধ্রুব সত্য- যা একদম খাঁটি কথা।
  • জীবদ্দশায়- জীবিত অবস্থায়।
  • মূর্ত- যেসব বস্তু স্পর্শ করা যায়, দেখা যায়। যেমন- ইট-কাঠ-পাথর।
  • বিমূর্ত- যা স্পর্শ করা যায় না, দেখা যায় না। যেমন- মায়া-মমতা-ভালোভাসা-দুঃখ।
  • দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক- দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক।
  • দৈব নিয়মেই সেই ঋণ মুকুবের দিন যেন আমাদের সবার জীবনে নির্দিষ্ট হয়ে আছে- কবে আমরা মারা যাবো এবং আমাদের সব ঋণ শোধ হবে সেই দিনটা যেন ভাগ্য ঠিক করে রেখেছে।
  • কালবেলা- মৃত্যুর সময়।
  • জীবন বোধের পরিচয়- জীবন সম্পর্কে বিশাল জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।

আরও পড়- WBCS পরীক্ষা সম্পর্কে A-Z খাঁটি তথ্য, All in one click

সবার সঙ্গে শেয়ার করুন
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

Leave a comment