পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত ল্যাপলাসের নীহারিকা মতবাদ, একাদশ শ্রেণি ভূগোল: Laplace Nebular Hypothesis

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত গ্যাসীয় মতবাদ ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। কান্টের মতবাদে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। সেগুলিকে দূর করে ওই মতবাদকে বিজ্ঞানসম্মত ও পরিমার্জিত ভাবে ফরাসি গণিতজ্ঞ পিয়ের সিমন ডি ল্যাপলাস ( Pierre-Simon Marquis de Laplace, 23 March 1749 – 5 March 1827) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ‘নীহারিকা মতবাদ’ (Nebular Hypothesis) নামে নতুন করে প্রকাশ করেন। ল্যাপলাস ‘এক্সপোজিশন অফ দ্য সোলার সিস্টেম’ গ্রন্থে তাঁর নেবুলা মতবাদ প্রকাশ করেন।

পুরোনো স্মৃতিঃ সৌরজগৎ কাকে বলে ?
 » সূর্য এবং তার চারপাশে প্রদক্ষিণরত গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ, ধূমকেতু ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক মিলে যে জগৎ তৈরি হয়েছে তাকেই সৌরজগৎ বলে। অতএব, সূর্য হল সৌরজগতের কেন্দ্র এবং গ্রহগুলি যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে সেটাই হল আমাদের সৌরজগতের পরিসর। সৌরজগতের মোট ভরের ৯৮% সূর্যের ভর এবং বাকি ২% ভর হল অন্যান্য গ্রহ – উপগ্রহ ও জ্যোতিষ্কদের।

ল্যাপলাসের নেবুলা মতবাদের মূল বক্তব্য: Nebular Hypothesis main points

পৃথিবী তথা আমাদের সৌরজগৎ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তার উপর ল্যাপলাস তাঁর মতামত ‘নেবুলা হাইপোথিসিস’ এ প্রকাশ করেছন। তাঁর মতবাদের মুখ্য উপজীব্য বিষয়গুলি নিচে দেওয়া হল।

  • আদিম নীহারিকাঃ ল্যাপলাসের মতে সৌরজগৎ কোন কঠিন বস্তুকণা দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। বরং উত্তপ্ত গ্যাস এবং ধূলিকণা দ্বারা সৃষ্ট মেঘপুঞ্জ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করেন উত্তপ্ত গ্যাস এবং ধূলিকণার ঘূর্ণায়মান বস্তুকণায় গঠিত নীহারিকা আগে থেকেই মহাকাশে অবস্থান করত।
  • সংকোচন এবং ঘূর্ণন বেগঃ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদিম অতিপ্রাকৃতিক নীহারিকা শীতল হয়ে সংকুচিত হতে থাকে। ফলে ঘূর্ণন বেগ এবং কেন্দ্রাতিগ বল বৃদ্ধি পায়।
  • বলয়ের সৃষ্টিঃ পরবর্তীতে নীহারিকার কেন্দ্রাতিগ বল ও মাধ্যাকর্ষণ বল সমান হলে বস্তুকণাগুলি ভর শূন্য হয় এবং স্থির হয়ে ভাসতে থাকে। এক সময় কেন্দ্রাতিগ বল মাধ্যাকর্ষণ বলের থেকে বেশি হলে নীহারিকার নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে ৯টি গোলাকার বলয়ের সৃষ্টি হয়।
  • সূর্য ও গ্রহ – উপগ্রহের গঠনঃ নীহারিকার উত্তপ্ত ও গ্যাসীয় কেন্দ্রীয় অংশটি ক্রমশ ঘন হয়ে সূর্যের রূপ নেয় এবং বলয়গুলি ধীরে ধীরে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে গ্রহে পরিণত হয়। এই কারণেই আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রীয় মন্ডল এখনও তরল ও উত্তপ্ত। একই প্রক্রিয়ায় গ্রহ থেকে উপগ্রহগুলি সৃষ্টি হয়েছে।

ল্যাপলাসের মতবাদের গুরুত্ব কী ? : Importance of Nebular Hypothesis

  • গ্রহগুলি নিজ নিজ কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, কিন্তু গ্রহগুলির কক্ষপথ একই সমতলে অবস্থিত। কক্ষপথগুলি কেন একই সমতলে অবস্থিত তার কারণ ব্যাখ্যা করে ল্যাপলাসের মতবাদ।
  • গ্রহ-উপগ্রহগুলি যে উত্তপ্ত ও গ্যাসীয় পদার্থ থেকে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়েছে এই ধারণার ব্যাখ্যা ল্যাপলাসের মতবাদে পাওয়া যায়।

আরও পড়- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার প্রশ্ন উত্তর

নেবুলা মতবাদের সমালোচনা: Criticism of Nebular Hypothesis

  • ল্যাপলাস বলেছেন নীহারিকা আগে থেকেই এই মহাকাশে ছিল। কিন্তু মহাকাশের বস্তুকণাগুলো এলো কোথা থেকে বা উৎস কী তা তিনি স্পষ্ট করে বলেননি।
  • নীহারিকার বলয় থেকে কীভাবে প্রায় গোলাকার গ্রহের সৃষ্টি হল তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ল্যাপলাস।
  • শুক্র গ্রহ পূর্ব থেকে পশ্চিমে আবার ইউরেনাস দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে আবর্তন করে। অপরদিকে বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের উপগ্রহের আবর্তনের দিক উল্টোদিকে। এর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ নেবুলা মতবাদ।
  • বিজ্ঞানীদের মতে গ্রহ সৃষ্টির জন্য যে মহাকর্ষ বলের প্রয়োজন তা নীহারিকা থেকে নির্গত বলয়ে থাকা সম্ভব নয়। নীহারিকার অঞ্চল থেকে যদি কেন্দ্রাতিক বলের কারণে বলয়ের সৃষ্টিও হয় তবুও সেই বলয়ের ভর কম হবে ও আকৃতিও ছোট হবে। তাই সেই বলয় থেকে শনি বা বৃহস্পতির মতো বড় বড় গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে এই ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়।
  • ল্যাপলাস তাঁর মতবাদে বলেছেন সূর্যের কৌণিক ভরবেগ সবচেয়ে বেশি কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় গ্রহগুলির কৌণিক ভরবেগ সবচেয়ে বেশি। কারণ পদার্থের ভর যত বেশি হবে তার কৌণিক ভরবেগ তত কম হয়। পদার্থের আয়তন এবং কৌণিক ভরবেগ পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক।
  • সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা গ্রহগুলি সূর্য থেকে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থান করে। আবার নিজ নিজ অক্ষের উপর কিছুটা হেলে আবর্তন করতে থাকে। কেন শুধুমাত্র ৯টি বলয় সৃষ্টি হল ? এই প্রশ্নের উত্তর যেমন নেই তেমনি গ্রহগুলির বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থান, আয়তনের পার্থক্য এবং বিভিন্ন কোণে অক্ষের উপর হেলে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না ল্যাপলাসের মতবাদ থেকে।

ইমানুয়েল কান্টের গ্যাসীয় মতবাদের সঙ্গে ল্যাপলাসের নেবুলা মতবাদের প্রধান পার্থক্য: Difference between Kant and Laplace theory


ইমানুয়েল কান্ট গ্যাসীয় মতবাদে বলেছেন সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ – উপগ্রহ সৃষ্টির আদি লগ্নে মহাকাশ শীতল ও গতিশীল কঠিন বস্তুকণা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। তারপর পরবর্তীতে সেই আদিম বস্তুকণাগুলি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর ফল স্বরূপ আরও পরে ওই কঠিন পদার্থগুলি উত্তপ্ত গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘপুঞ্জে পরিণত হয় এবং গতিশীল হয়ে ঘুরতে থাকে। এভাবে জন্ম নেয় নীহারিকার। উত্তপ্ত গ্যাস ও ধূলিকণার থেকেই ধীরে ধীরে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ- উপগ্রহগুলি সৃষ্টি হয় বলে কান্ট তাঁর মতবাদে দাবি করেছেন।
অপরদিকে ল্যাপলাস তাঁর নেবুলা মতবাদে সৌরজগৎ শীতল ও গতিহীন কঠিন বস্তুকণা দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে কান্টের এই বক্তব্যেকে অস্বীকার করেন। তিনি মনে করেন আগে থেকেই মহাবিশ্বে উত্তপ্ত গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘপুঞ্জ অবস্থিত ছিল। আমরা যাকে বর্তমানে নীহারিকা বা নেবুলা বলি তা কোটি কোটি বছর আগেই মহাকাশে ছিল। সেই নীহারিকা থেকেই বর্তমান সৌরজগতের জন্ম হয়েছে। পৃথিবী সৃষ্টির মতবাদ হিসাবে ল্যাপলাসের মতবাদকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়- পৃথিবীর উৎপত্তি ও ভূঅভ্যন্তর প্রশ্ন উত্তর

আরও পড়- শাস্ত্র হিসেবে ভূগোল

সবার সঙ্গে শেয়ার করুন
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

Leave a comment