মিশরীয় পিরামিডের ইতিহাস: মিশরের পিরামিড রহস্য ফাঁস ! পিরামিড সম্পর্কে অজানা তথ্য ভাণ্ডার

মিশরের পিরামিড, পৃথিবীর ইতিহাসের এক অন্যতম আকর্ষণীয় ও রহস্যময় স্থাপত্য নিদর্শন। হাজার বছর ধরে এই বিশাল পাথরের স্তূপগুলো মানবজাতির কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার এই মহাকাব্যিক নির্মাণশৈলী শুধুমাত্র তাদের অসাধারণ দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পরিচয় দেয় না, বরং এটি মানবজাতির ইতিহাসের এক অসীম রহস্যের জন্ম দেয়। ছবিতে বা সিনেমায় আমরা প্রায়শই দেখে থাকি তিনটি বিশাল আকৃতির পিরামিডকে স্বগর্বে আকাশকে ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় পিরামিডটি হল বিখ্যাত ‘Great Pyramid of Giza’ । আজকে আমরা জানবো এই পিরামিড নির্মাণ সংক্রান্ত কিছু দুর্দান্ত তথ্য যা কোনো সিনেমার রোমাঞ্চকর কাহিনির থেকে কম নয়।

পিরামিড কেন তৈরি করা হয়েছিল

আনুমানিক, প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সাল নাগাদ ‘Great Pyramid of Giza’ নির্মাণ করা হয়। সেই সময়ে মিশরের রাজারা ‘ফারাও’ নামে পরিচিত ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে মৃত্যুর পর তাদের আত্মা পুনরায় জীবিত হবে এবং স্বর্গে যাবে। এই বিশ্বাস থেকেই ফারাওদের সমাধিক্ষেত্র হিসেবে পিরামিড নির্মাণ করা হয়। পিরামিডের মধ্যে ফারাওদের মৃতদেহ মমি করে সংরক্ষণ করা হতো। সেই সময়ে মিশরীয়দের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃতদেহের সঙ্গে যত বেশি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হবে ততই মৃত ব্যক্তির আত্মা সুখ-শান্তিতে থাকবেন। আর তাই পিরামিডের মধ্যে ধনসম্পদ, অলংকার ও অন্যান্য নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হতো।

গিজার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিড হল, খুফুর পিরামিড, যা ‘গ্রেট পিরামিড অব গিজা’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে চতুর্থ রাজবংশের দ্বিতীয় ফারাও খুফু (যিনি গ্রিক ভাষায় Cheops নামে পরিচিত) এই পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন। পিরামিডটি বর্তমান ইজিপ্ট দেশের (প্রাচীন নাম মিশর) রাজধানী কায়রো শহরের পশ্চিম দিকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং এটির পূর্ব দিকে নীল নদ প্রবাহিত হয়েছে। গিজা পিরামিড কমপ্লেক্সে তিনটি প্রধান পিরামিড রয়েছে, খুফু পিরামিড বাদে বাকি দুটি হল খাফরে, এবং মেনকাউরে।

ইউনেস্কো (UNESCO) গিজার পিরামিড কমপ্লেক্সকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’ (World Heritage Site) হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে গিজার পিরামিড ও গ্রেট স্ফিংস (Great Sphinx) সহ পুরো এলাকা সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত স্থানের মর্যাদা লাভ করে।

পিরামিড কিভাবে তৈরি করা হয়েছিল

গ্রেট গিজা পিরামিড একসময় ১৪৬.৬ (৪৮১ ফুট) মিটার উঁচু ছিল, তবে হাজার হাজার বছরের ধকলে ক্ষয়ে গিয়ে এখন এর উচ্চতা প্রায় ১৩৮ মিটারে দাঁড়িয়েছে। পিরামিডের প্রতিটি পাশের দৈর্ঘ্য ২৩০ মিটার। এটি প্রায় ২৩ লক্ষ পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি, যার প্রতিটি গড় ওজন প্রায় ২.৫ টন। আবার কিছু পাথরের ওজন ৮০ টন পর্যন্ত। পিরামিডের মোট ওজন প্রায় ৬ মিলিয়ন টন, যা বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং বুর্জ খলিফার চেয়ে অনেক বেশি ভারী। বুর্জ খলিফার ওজন মাত্র ৫ লক্ষ টন (০.৫ মিলিয়ন টন)।

পিরামিডটি প্রধানত চুনাপাথর (limestone), গ্রানাইট (granite), এবং মর্টার (mortar) দিয়ে তৈরি। চুনাপাথর পিরামিডের মূল কাঠামোর জন্য, গ্রানাইট অভ্যন্তরীণ কক্ষের জন্য, এবং মর্টার পাথরগুলিকে সংযুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং গবেষণার ভিত্তিতে অনুমান করা হয় গিজা পিরামিড নির্মাণে প্রায় ২০-৩০ বছর সময় লেগেছিল এবং ২০০০০ থেকে ৩০০০০ হাজার শ্রমিক এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তবে যাই হোক এই বিশাল আকারের পিরামিড আজও মানব ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময় হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

পিরামিডের রহস্য

গিজা পিরামিডের নির্মাণে বেশ কিছু আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় বিষয় রয়েছে যা আজও মানুষকে বিস্মিত করে। এই রহস্য ভেদ আজও মানুষের করা সম্ভব হয়নি। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরা হল:

1. ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা: প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে আধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ছাড়াই এত বিশাল আকারের একটি পিরামিড কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল, তা এক বড় রহস্য। পাথরের ব্লকগুলো কীভাবে এত উচ্চতায় তোলা হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকরা দিতে পারেননি।

2. জ্যামিতিক নিখুঁততা: গিজা পিরামিডের প্রতিটি পাশ পৃথিবীর চারটি প্রধান দিকের (পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ) সঙ্গে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ধরনের জ্যামিতিক নিখুঁততা সেই সময়ে কীভাবে সম্ভব ছিল, তা আজও গবেষকদের কৌতূহল জাগায়।

3. পাথরের বিশাল আকার ও ওজন: পিরামিডে ব্যবহৃত পাথরের ব্লকগুলির গড় ওজন প্রায় ২.৫ টন, আর কিছু ব্লকের ওজন ৮০ টন পর্যন্ত। এত বড় ও ভারী পাথর কীভাবে দূরবর্তী খনি থেকে আনা হয়েছিল এবং স্থাপন করা হয়েছিল, তা রহস্যময়। কেননা সেই সময় চাকাই (wheel) আবিষ্কৃত হয়নি। কোনো রকম চাকার দ্বারা চালিত যানবাহন, যন্ত্রপাতি বা উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই কীভাবে বিশাল ওজনের পাথরের ব্লকগুলি স্থানান্তরিত করা হল, তা এক অজানা গভীর রহস্য।

4. নির্মাণের সময়সীমা: এত বড় আকারের পিরামিড মাত্র ২০-৩০ বছরের মধ্যে কীভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল, তা বিজ্ঞানীদের অবাক করে। পিরামিড নির্মাণে ব্যবহৃত চুনাপাথর আশেপাশের খনিতে পাওয়া গেলেও যে গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়েছিল তা আশেপাশের অঞ্চলে পাওয়া যেত না। গিজা থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আসওয়ান (Aswan) থেকে গ্রানাইট আনা হয়েছিল। তারপর সেই পাথরের খণ্ড কাটা, পালিশ করা, পিরামিডে ঠিক ভাবে বসানো ইত্যাদি কাজ উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যতীত বহু সময় সাপেক্ষ। এই অল্প সময়ে এত কাজ কীভাবে সম্পন্ন করা হয়েছিল, তা এখনও বিরাট রহস্যজনক।

5. গোপন কক্ষ ও পথ: পিরামিডের অভ্যন্তরে থাকা সংকীর্ণ পথ ও গোপন কক্ষগুলির জটিল নকশা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। অনেক কক্ষ এমনভাবে লুকানো ছিল যে, সেগুলো আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের আগে পর্যন্ত অজানা ছিল।

6. মর্টারের রহস্য: পিরামিডের পাথরগুলির মধ্যে ব্যবহৃত মর্টার আজ পর্যন্ত পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা যায়নি। এর রাসায়নিক উপাদান এবং উৎপত্তি সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে।

7. খুফুর পিরামিডের মূল উদ্দেশ্য: যদিও এটি একটি সমাধি হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, তবে পিরামিডের অভ্যন্তরে খুফুর মমি বা মূল্যবান সম্পদ কখনোই পাওয়া যায়নি। ফলে পিরামিড নির্মাণের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে। তবে পিরামিডগুলো যে সমাধি হিসাবেই তৈরি করা হয় ছিল এর সমর্থনে যে জোরালো যুক্তি পাওয়া যায় তা হল, যেহেতু কয়েক হাজার বছর আগে এগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল তাই এত বছরে কেউ হয়তো পিরামিডে অবস্থিত ধনসম্পদ লুঠ করে নিয়েছে।

শেষকথা

প্রাচীন মিশরীয়দের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও পিরামিডগুলি তাদের প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে। আজকের দিনে পিরামিড শুধু পর্যটকদের আকর্ষণ নয়, বরং স্থাপত্যবিদ্যা এবং ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। পিরামিডের রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু এই আশ্চর্য স্থাপনাগুলো এখনও আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, প্রাচীন এক সভ্যতার গৌরবগাথা ও মানবজাতির অমর কীর্তির সাক্ষী হয়ে।

পিরামিডের জাদু এবং রহস্য আমাদের কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। যদিও বিজ্ঞানীরা এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক গবেষণা করেছেন, তবু পিরামিডের কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। এই অজানার আকর্ষণই পিরামিডকে আরও রহস্যময় করে তোলে, যা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষকে এই প্রাচীন নিদর্শন দেখতে উদ্বুদ্ধ করে।

আরও পড়ুন- পলিগ্রাফ টেস্ট কি ? মিথ্যা কথা বললেই ধরা পড়ে যাবেন ! মারাত্মক এই পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে নিন ঝটপট

আরও পড়ুন-  অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস ও তার ৩ হাজার বছরের জীবনচক্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

আরও পড়ুন- হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স কী ? Eligibility, Job Opportunity, Fees In Details

সবার সঙ্গে শেয়ার করুন
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

Leave a comment