পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত জোয়ার মতবাদ, জিনস এবং জেফ্রি, : Jeans and Jeffreys Tidal Theory

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জেমস জিনস্ ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত ‘জোয়ারি মতবাদ ‘ (Tidal Hypothesis) প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে আর এক ব্রিটিশ ভূ-পদার্থবিদ হেরল্ড জেফ্রি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জিনসের মতবাদের পরিমার্জিত সংস্করণ (Modification) প্রকাশ করেন। সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই সম্পর্কে একটি আধুনিক মতবাদ হল ‘টাইডাল হাইপোথেসিস’। মতবাদটি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।

এই মতবাদ অনুসারে, আমাদের সৌরজগৎ সৃষ্টির আগে থেকেই সূর্য ছিল। কোটি কোটি বছর আগে মহাবিশ্বে সূর্য তখন বিশালাকার গ্যাসীয়পিণ্ডের আকারে অবস্থান করত। শুধু সূর্যই নয় সেই সময় আরও একটি বড় নক্ষত্র ছিল। বিজ্ঞানীরা ওই দৈত্যাকার নক্ষত্রের নাম দিয়েছেন ‘ আগন্তুক স্টার’ ( Intruding Star)। আদিম সূর্য এবং আগন্তুক স্টারের মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে বর্তমান সূর্য এবং পৃথিবীর সহ অন্যান্য গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

জেমস জিনস্ এবং হেরল্ড জেফ্রির জোয়ারি মতবাদ এর মূল বক্তব্য: Tidal Hypothesis main points

  • আদিম সূর্য (Primitive Sun) এবং আগন্তুক নক্ষত্রের (Intruding Star) মাধ্যাকর্ষণ বলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলি সৃষ্টি হয়েছে।
  • আদিম সূর্য মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের উত্তপ্ত গ্যাসীয়পিণ্ড রূপে অবস্থান করত এবং ঘূর্ণায়মান ছিল। সেই সময় মহাকাশে সূর্যের থেকে আরও অনেক বড় একটি নক্ষত্র ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সেই নক্ষত্রকে ‘আগন্তুক নক্ষত্র’ বলা হয়েছে।
  • আদিম সূর্য এবং আগুন স্টার উভয়ই মহাকাশে স্থির ছিল না। পরিক্রমণ গতির জন্য কোন এক সময় আদিম সূর্য এবং আগন্তুক স্টার একে অপরের কাছাকাছি এসে যায়। ফলে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র অনুযায়ী বড় নক্ষত্রটি সূর্যের উপর প্রচন্ড আকর্ষণ বলের সৃষ্টি করে। চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীতে যেমন জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনি আগন্তুক স্টারের আকর্ষণ বলে সূর্যের গ্যাসীয়পিণ্ড স্ফীত হয়ে ওঠে।
  • আকর্ষণ বল আরও জোরালো হলে সূর্যের পৃষ্ঠদেশ থেকে কিছুটা স্ফীত গ্যাসীয়পিণ্ড মূল সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা ওই বিচ্ছিন্ন গ্যাসীয়পিণ্ডটি কলার মোচার মতো মাকু আকৃতির ছিল বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এই বিচ্ছিন্ন অংশটির নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা ফিলামেন্ট (Filament)। বিচ্ছিন্ন অংশটি সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। পরবর্তীতে মাকু আকৃতির বিচ্ছিন্ন গ্যাসীয় পিণ্ডটি আরও কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত হয়। ওই বিভক্ত খণ্ডগুলি কালক্রমে বিভিন্ন গ্রহ এবং উপগ্রহের রূপ নিয়েছে বলে এই মতবাদের প্রবক্তা জিনস্ ও জেফ্রি মনে করেন। অবশিষ্ট উত্তপ্ত গ্যাসীয়পিণ্ডটি বর্তমান সূর্য রূপে অবস্থান করছে।

আরও পড়- WBCS পরীক্ষা সম্পর্কে A-Z খাঁটি তথ্য, এক ক্লিকেই সমস্ত data

জেমস জিনস্ ও হেরল্ড জেফ্রির জোয়ারি মতবাদ অনুযায়ী গ্রহ – উপগ্রহের উৎপত্তি

  • মাকু আকৃতির ফিলামেন্টটি সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে শীতল ও সংকুচিত হয়।
  • প্রচন্ড সংকোচন চাপের ফলে ফিলামেন্টটি আটটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই আটটি খন্ড ঘনীভূত হয়ে প্রথমে তরল এবং পরে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়ে গ্রহের নির্মাণ করেছে।
  • মাকু আকৃতির গ্যাসীয়পিণ্ডটির মাঝখানের অংশটি খন্ডিত হয়ে শনি এবং বৃহস্পতির মতো বড় গ্রহগুলির গঠন করেছে। এই জন্যই বৃহস্পতির আগের ও পরের গ্রহগুলো ক্রমশ আকৃতিতে ছোট হয়ে এসেছে। আদিম সূর্য থেকে নির্গত গ্যাসীয় ফিলামেন্টটি মাকু আকৃতির ছিল বলেই এমনটা হয়েছে।
  • মাকু আকৃতির ফিলামেন্টের প্রাথমিক আটটি খন্ডের মধ্যে যেগুলি বড় খন্ড সেগুলি ধীরে ধীরে ঠান্ডা ও সংকুচিত হয়ে গ্রহে পরিণত হয়েছে। শনি এবং বৃহস্পতি এখনও সম্পূর্ণ কঠিন পদার্থে পরিণত হতে পারেনি। এই দুই গ্রহ এখনও হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাসের পিণ্ড হয়ে আছে। অপেক্ষাকৃত ছোট খণ্ডগুলি দ্রুত ঠান্ডা হয়ে কঠিন গোলাকৃতি গ্রহে পরিণত হয়েছে। শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল এই গ্রহগুলি ছোট খন্ডগুলি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে কঠিন পদার্থের গ্রহ রূপে অবস্থান করছে।
  • ছোট খণ্ডগুলি দ্রুত ঠান্ডা ও ঘনীভূত হয়ে কঠিন পদার্থের গ্রহে পরিণত হয়েছে বলে এইসব গ্রহ থেকে আবার কোন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে খুব বেশি উপগ্রহ তৈরি হতে পারেনি। এই কারণে মঙ্গল এবং পৃথিবীর উপগ্রহের সংখ্যা খুব কম। বুধ এবং শুক্রগ্রহের তো কোনও উপগ্রহই নেই। কিন্তু যে সমস্ত বড় খন্ডগুলি ধীরে ধীরে শীতল হয়ে গ্রহে পরিণত হয়েছে সেগুলি এখনও ঘনীভূত হয়ে কঠিন পদার্থের পরিণত হতে পারেনি তাই এই গ্রহগুলির বাইরে বিচ্ছিন্ন কিছু খন্ড উপগ্রহ হয়ে বিরাজ করছে। শনি এবং বৃহস্পতির উপগ্রহের সংখ্যা সেজন্য অনেক বেশি।

জোয়ারি মতবাদের গুরুত্ব

  • জিনস্ এবং জেফ্রির জোয়ারি মতবাদ পৃথিবী তথা আমাদের সৌরজগতের বিজ্ঞানসম্মতভাবে উৎপত্তির ব্যাখ্যা করে তাই বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই মতবাদ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
  • এই মতপার্থ থেকে বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহের অবস্থান, কক্ষপথ, গ্রহগুলির আকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
  • এই মতবাদে বলা হয়েছে গ্রহগুলি আদিম উত্তপ্ত গ্যাসীয়পিণ্ড থেকে ধীরে ধীরে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এই মতবাদ অনুযায়ী তাই সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ অংশ কেন এখনও উত্তপ্ত ম্যাগমা দিয়ে তৈরি এবং গ্যাসীয় গ্রহ হিসেবে কেন শনি ও বৃহস্পতি এখনও রয়ে গেছে।

জোয়ারি মতবাদের সমালোচনা

  • প্রযুক্তির হাত ধরে আধুনিক বিজ্ঞানীরা সূর্যের উপর গবেষণা করে জেনেছেন সূর্য প্রায় ৯৮ শতাংশ হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে তৈরি। সেক্ষেত্রে আদিম সূর্য থেকে কঠিন পদার্থ ও ধাতু দিয়ে নির্মিত গ্রহ-উপগ্রহগুলি সৃষ্টি হয়েছে এটা মানতে অনেক বিজ্ঞানী অস্বীকার করেন।
  • মতবাদে যে আগন্তুক নক্ষত্রের (Intruding Star) কথা বলা হয়েছে সেই নক্ষত্র কোথা থেকে এলো এবং কোথায় চলে গেল সেই সম্পর্কে স্পষ্ট কোন আলোকপাত মতবাদে করা হয়নি। বিজ্ঞানী বি.লেভিন মনে করেন পূর্বের সীমাহীন মহাকাশে যদি অনেক নক্ষত্র থেকেও থাকে তাহলেও নক্ষত্রগুলি পরস্পর এত দূরে অবস্থান করত যে দুটি নক্ষত্র কাছাকাছি এসে জোয়ারের সৃষ্টি করেছে এই ধারণাকে তিনি কষ্ট কল্পনা মনে করেন।
  • আদি সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন মাকু আকৃতির ফিলামেন্টটি খন্ড খন্ড হয়ে আটটি গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে তাই মাঝের অংশটি মোটা ছিল বলে শনি এবং বৃহস্পতি বড় আকারের গ্রহ এবং অন্যান্য গ্রহগুলি ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। কিন্তু বৃহস্পতির পাশে মঙ্গল গ্রহ ছোট কিন্তু মঙ্গলের পরে পৃথিবী কেন মঙ্গলের থেকে বড় এই ব্যাখ্যা জোয়ারি মতবাদ দিতে পারেনা।
  • সৌরজগতের মোট কৌণিক ভরবেগের ৯৮ শতাংশ কৌণিক ভরবেগ গ্রহ-উপগ্রহ ও অন্যান্য জ্যোতিষ্কদের এবং সূর্যের কৌণিক ভরবেগ মাত্র ২ শতাংশ। সূর্যের এত কম কৌণিক ভরবেগের কারণ এই মতবাদ ব্যাখ্যা করতে পারে পানেনি।

আরও পড়- পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত ল্যাপলাসের নীহারিকা মতবাদ

আরও পড়- পৃথিবীর উৎপত্তি ও ভূঅভ্যন্তর প্রশ্ন উত্তর

আরও পড়- হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স কী ?

সবার সঙ্গে শেয়ার করুন
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

Leave a comment