ITI শব্দটির সঙ্গে অনেক ছাত্রছাত্রীই পরিচিত, কিন্তু আসলে ITI জিনিসটা কী ? এবং ITI করে জীবনে কী কী কাজের সুবিধা হয় বা উন্নতি করা যায় সেটা সম্পর্কে বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরই স্পষ্ট ধারনা নেই। আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় অনেক ছেলেমেয়েই আছে যারা পড়াশোনায় বেশ ভালো। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ফাস্ট ক্লাস বা স্টার পায় তারপর সাইন্স (Science) নিয়ে পড়াশোনা করে কিন্তু তবুও তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এরপর দেখা যায় বছর দুই-চার পরে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলে। জীবনে কী করবে তার কোনও দিশা থাকে না। এদিকে বয়স বেড়ে যায় সমান তালে বাড়ে বেকারত্বের জ্বালা। কী নিয়ে পড়াশোনা করলে ভালো চাকরি-বাকরি পাওয়া যায় বা ব্যবসা করেও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য বা গাইডেন্স (Guidance) থাকে না বলেই অনেক ছাত্রছাত্রীদের মেধা থাকা সত্ত্বেও জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে ITI সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল, যাতে করে এই লেখা পড়ে ITI নিয়ে পরিষ্কার ধারনা তৈরি হয়।
ITI এর পুরো অর্থ এবং উদ্দেশ্য (What Is Full Form Of ITI & Its Objectives)
ITI এর পুরো অর্থ হল Industrial Training Institute । সাধারণ স্কুল-কলেজে প্রথাগত শিক্ষার (Formal Education) মাধ্যমে পড়ুয়াদের Arts, Science বা Commerce বিষয়ে পড়ানো হয়। প্রথাগত শিক্ষায় ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয়। মাধ্যমিক বা কলেজ পাসের পর শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ডিগ্রি। এখানে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কর্ম জীবন বা জীবিকা নিয়ে ভাবা হয় না। অপরদিকে, ITI হল বৃত্তিমূলক শিক্ষা। যেখানে কোনো নির্দিষ্ট পেশাকে লক্ষ্য রেখে পড়ুয়াদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। যেমন, কেউ যদি ইলেকট্রিশিয়ান কোর্সে ভর্তি হয় তবে তাকে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র-সরঞ্জাম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হবে। বাড়ি বা বড়ো বড়ো অফিস-বিল্ডিং এ ইলেকট্রিক তারের ওয়ারিং করা, স্যুইচ বোর্ড বানানো বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম লাগানো সম্পর্কে শেখানো হবে। শুধু তাই নয়, বড়ো কোনো বিল্ডিং এ ইলেকট্রিক পরিষেবা যাতে ঠিকঠাক হয়, লাইট, ফ্যান, AC বা অন্যান্য সকল বৈদ্যুতিক যন্ত্র যাতে ভালোভাবে কাজ করে; এই বিদ্যার পাশাপাশি ইলেকট্রিকের কাজ করতে অনেক ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়, সেই সম্পর্কেও ইলেকট্রিশিয়ান কোর্সে শেখানো হয়। এর ফলে ইলেকট্রিকের কাজ শেখার পর কোনো পড়ুয়ার সামনে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় এবং বেসরকারি কোম্পানিতে কাজের যেমন সুযোগ থাকে তেমনি নিজেও বাড়িতে বসে ব্যবসা করে আয়-উপার্জন করতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের একটি কাজ শেখানো হয়, যে কাজ করে সে রোজগার করে বেঁচে থাকতে পারবে। এখানে জীবিকা বা পেশাগত শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে টাকা আয়ের রাস্তা দেখানো হয় এবং ওই সম্পর্কেই জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়।
ITI এর মধ্যে শুধু যে ইলেকট্রিশিয়ানের কোর্সেই আছে এমনটা নয়। কম্পিউটার, খাদ্য উৎপাদন, ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটিশিয়ান, রঙের কাজ, ঝালাইয়ের কাজ ইত্যাদি বহু বিষয়ে পড়ানো হয়। প্রত্যেকটা কোর্সেই শিক্ষার্থীদের একটা কাজ ভালোভাবে শেখানো হয়, যাতে ওই কাজ করে সে রোজগার করতে পারে। যে সমস্ত ছেলেমেয়েদের পারিবারিক বা আর্থিক কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না এবং দ্রুত রোজগারে নামতে হয়, তাদের জন্য ITI একটি খুব ভালো অপশন।
ITI কোর্সের ভাগ (Types Of ITI Courses)
ITI কোর্সগুলো মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে, এগুলি হল-
- Engineering trades
- Non-engineering trades
ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সগুলো টেকনিক্যাল ধরনের, যেমন, ইলেকট্রিশিয়ান, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট, ফিটার, ইনফরমেশন টেকনোলজি ইত্যাদি। এই কোর্সে জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে অংক ও পদার্থ বিজ্ঞান থাকা জরুরি। অপরদিকে নন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সেগুলি হল কার্পেন্টার (রং এর কাজ), ফ্যাশন ডিজাইন, ফুড প্রডাকশন, সেলাইয়ের কাজ, ট্যুরিস্ট গাইড, ক্যামেরার কাজ, বেকারি ও দুগদ্ধজাত উৎপাদন, চামরার কাজ ইত্যাদি।
ITI কোর্সের সময়সীমা (ITI Course Duration)
বহু ধরনের কোর্স রয়েছে ITI এ। কোর্সের ধরন অনুযায়ী ITI কোর্সগুলো ৬ মাস থেকে ২ বছরের হয়। যেমন, SMARTPHONE TECHNICIAN CUM APP TESTER, এই কোর্সটি ৬ মাসের। আবার MULTIMEDIA ANIMATION & SPECIAL EFFECTS এবং ELECTRONICS MECHANIC কোর্স দুটি যথাক্রমে ১ বছর ও ২ বছরের হয়ে থাকে।
শিক্ষাগত যোগ্যতা (ITI Eligibility Criteria)
ITI কোর্সের মূল লক্ষ্য যেহেতু শিক্ষার্থীকে কোনো কর্মে দক্ষ করে তোলা তাই ITI করার জন্য উচ্চ শিক্ষার (BA বা MA পাস) দরকার নেই। ন্যূনতম অষ্টম পাসেই ITI কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের কোর্সগুলির জন্য অংক ও পদার্থ বিজ্ঞান সহ মাধ্যমিক পাস হতে হয়। অষ্টম পাসে কী কী কোর্স রয়েছে এবং মাধ্যমিক যোগ্যতায় কী কী কোর্স আছে তা নিচে দেওয়া রয়েছে।
বয়স (Age For ITI Admission)
ITI কোর্সে আবেদন করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীর বয়স ১৪ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে হতে হবে।
কীভাবে ITI এ ভর্তি হওয়া যায় ? (The admission process of ITI)
পশ্চিমবঙ্গে ITI কোর্সে ভির্তির জন্য আলাদা করে কোনো Entrance Exam দিতে হয় না। অষ্টম শ্রেণিতে অথবা মাধ্যমিক বা সমতুল্য পরীক্ষায় প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়ন পর্ষদ প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে ITI কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য আবেদনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আগ্রহীরা সরাসরি অনলাইনে আবেদন জমা করতে পারে। পরবর্তীতে পর্ষদের তরফে যোগ্য প্রার্থীদের মেধা তালিকা প্রকাশ করে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া হয়। ২০২৪-২৫ সেশনের জন্য এবারের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ কারিগরি দফতর। সেই প্রতিবেদন দেখতে এবং এবারের জন্য আবেদন জানাতে এখানে টিপুন।
ITI কোর্সের তালিকা (ITI Courses List)
রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে অষ্টম এবং মাধ্যমিক পাসে অনেক ধরনের কোর্স করানো হয়। ITI কলেজগুলিতে কী কী কোর্স পড়ানো হয়, কোন কোর্সের কী শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কোর্সের সময়সীমা কত তার তালিকা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া রয়েছে। নিচে ITI কোর্স তালিকার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের লিঙ্ক দেওয়া হল।
ITI কোর্সের তালিকা | |
শেষ কথা
বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে কাজের বড়োই অভাব। রাজ্যের প্রায় ঘরে ঘরে MA-BA পাস করা ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হয়েও চাকরির অভাবে বেকার হয়ে বাড়িতে বসে রয়েছে। রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার কোনো সরকারেই দেশের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের কথা তেমনভাবে বিবেচনা করছে না। এদিকে স্কুল-কলেজে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা না পাচ্ছে সরকারি চাকরির সুযোগ, না পাচ্ছে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি। কারণ বেসরকারি সংস্থায় সাধারণ স্কুল-কলেজের ডিগ্রির কোনো মূল্য নেই। বেসরকারি ক্ষেত্রে চাই কোনো একটি কাজে দক্ষতা, যা প্রথাগত শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয় না। বেসরকারি সংস্থায় ভালো মাইনের ভালো কাজ পেতে গেলে কাজের দক্ষতাটাই আসল কথা। ITI কোর্সগুলিতে শিক্ষার্থীদের তাই বিভিন্ন কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়াস করা হয়। যাতে করে তারা সহজেই কাজ খুঁজে নিতে পারে। তাই পরিশেষে বলা যায় বর্তমান সময়ে ITI কোর্সের মাধ্যমে নিজেকে কোনো একটি কাজে ‘মাস্টার’ করে তোলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। অবশ্য যারা নিজের মেধার ভিত্তিতে জীবনে বড়ো কিছু করার স্বপ্ন দেখে তাদের কথা ভিন্ন।